সাফল্য লাভের কৌশল 

আসলে সফলতা কি? কিভাবেই বা তা ঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়? এ নিয়ে ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘ Failure is the pillar of success অর্থাৎ  ব্যর্থতা সফলতার মূল চাবি কাঠি ’  আমরা ছোটবেলা থেকে এ প্রবাদটি শোনে আসছি । ব্যক্তিগত কিংবা কর্মজীবনে আমরা সবাই সাফল্য এবং ব্যর্থতার সূক্ষ্ম সীমারেখায় যুক্ত পথের যাত্রী। যে পথে সাফল্য এবং ব্যর্থতা পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হাঁটে। তাই, সফল হতে চাইলে আপনাকে ব্যর্থও হতে হবে। শিখতে হবে আশপাশের মানুষের ব্যর্থতা থেকেও।

এই বিষয়টি সুস্পষ্ট যে সফল মানুষরা কিন্তু কেবল জন্মসূত্রে কিংবা ভাগ্যবলে সফল নন। সাফল্যের পেছনে থাকে বিস্তর পরিশ্রম, ত্যাগ, অধ্যবসায় ও ঝুঁকি গ্রহণের গল্প। চলুন জেনে নেই সাফল্যের গোপন রহস্য সম্পর্কে 

লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং ধৈর্য ধারণ করেন: 

সফল ব্যক্তিরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে নিজের সম্পূর্ণ মনোবল প্রয়োগ করেন। এই সম্পর্কে বিখ্যাত রেনেসাঁ শিল্পী মাইকেল হেল্লো বলেন ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের লক্ষ্য খুব বড় হয় না। তাই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি না।’ তাই কিছু সময় স্বাভাবিকের চেয়ে একটু অন্য ধরনের স্বপ্ন দেখা উচিত। যা আপনাকে আপনার লক্ষ্যে নিয়ে যাবে। ইতালীয় রেনেসাঁসের কালজয়ী চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতে, ‘সাফল্য খুব ধীরে ধীরে আসে। অনেক লোকই খুব বেশি সময় ধৈর্য ধরে থাকতে পারে না। তারা লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যায় এবং পিছিয়ে পড়ে। ফলে কর্মঠ হওয়া একান্ত জরুরি। কাজে অলসতা করলে সফলতা অর্জন করা একেবারেই অসম্ভব।

সাহসিকতার সঙ্গে ব্যর্থ হন: 

ব্যর্থতা আসবেই। তা আপনি যতই গুণান্বিত হন না কেন। সফল মানুষরা এই সহজ সত্যটাকে মেনে নেন। তারা ব্যর্থতার ভেতর দিয়েই সাফল্যের অন্বেষণ চালিয়ে যান। যখন সাধারণ মানুষ হাল ছেড়ে দেন, তখনও তারা চেষ্টা চালিয়ে যান। একই ব্যর্থতার বৃত্তে জড়ান না বারবার । জীবন থেকে শিক্ষা নেন। ফোর্ড মোটর কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ডের মতে, ‘ব্যর্থতা আপনাকে পুনরায় শুরু করার সুযোগ করে দেয়। এ সময়টা সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার।’ কারণ প্রতিটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা, প্রতিটি প্রত্যাখ্যান সফলতার চাবিকাঠি। একজন ব্যর্থ লোক চাইলেই খুব তাড়াতাড়ি মানিয়ে উঠতে পারে। ব্যর্থতা ব্যক্তিকে শিক্ষা দেয়।অ্যাপল কম্পিউটারের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস সফলতা অর্জনের জন্য সাহসী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, ‘হৃদয় এবং অন্তর্দৃষ্টিতে যে সাহস লুকিয়ে আছে, সফলতা অর্জনের জন্য তা বাইরে বের করে আনতে হবে। ভাবতে হবে, আপনি যা জানেন তা ঠিক। বাকি সবাই দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত।’ তাই নিজের কাজের প্রতি আস্থা থাকতে হবে। সফলতার জন্য সাহসের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

শুধুমাত্র ভাগ্যে বিশ্বাসী হন না: 

সাফল্য কদাচিৎ ভাগ্যের দান। যদিও সাফল্যে ভাগ্যের সহায়তা দরকার পড়ে। তবে একনিষ্ঠতা, শ্রম আর ঘামের মূল্যেই মূলত সাফল্য অর্জন করে নিতে হয়। অনেক সময় ভাগ্য বিরূপ হতেই পারে। তবে পরিশ্রম দিয়ে তা অতিক্রম করে ছিনিয়ে আনা যায় সাফল্য। সফল ব্যক্তিরা তা-ই করেন।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘কোন কাজে যদি নিরুৎসাহিত না হন, তাহলে আপনার সফলতা আসবেই।’ সবসময় নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যান। নিজের কাজকে কখনো বোঝা ভাববেন না। নিজের ওপর কাজ চাপিয়ে দেবেন না। সফল ব্যক্তিরা নিজের প্রতি আস্থাশীল হন। নিজের শক্তি এবং দুর্বলতার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হন। নিজেকে দিয়ে কি সম্ভব আর কি সম্ভব না এ ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা থাকায় তারা সুসিদ্ধান্ত নিতে পারেন বেশিরভাগ সময়।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখেন: 

সচেতন পর্যবেক্ষণ সার্বিক পরিস্থিতির পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। কোথায় কি ঘাটতি, তা পুরনে কি যা করণীয়; যা করণীয় তার সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা এই সব কিছু বুঝতে পারা যায় সচেতন পর্যবেক্ষণে। সফল ব্যক্তিরা যে সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানেন, এমনটা নয়। তবে তারা যে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপর হন। ভয়ে কিংবা নিশ্চয়তার চিন্তায় পিছু হটেন না। শুধু অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নয়, সফল ব্যক্তিরা চোখ রাখেন সার্বিক পরিস্থিতিতে। দেখতে চেষ্টা করেন সামগ্রিক ফলাফল। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ- এই তিনকে এক সুতোয় গেঁথে তৈরি করেন সাফল্যের বরমাল্য। সফল হতে হলে সাবধানতা প্রয়োজন। চোখ কান খোলা রেখে চারপাশের পরিবেশ বোঝার চেষ্টা না করার মানে হলো- সুযোগ হাতছাড়া করা। সফল ব্যক্তিরা সাবধানতার সঙ্গে শোনেন, ভাবেন ও বোঝেন।

যোগাযোগে তুখোড় হন: 

সফল ব্যক্তিরা শাণিত যোগাযোগ দক্ষতার অধিকারী হন। সহজেই মানুষকে বুঝতে এবং বোঝাতে পারেন। সমঝোতায় পটু হন। বাচনভঙ্গিতে হন আত্মবিশ্বাসী।আমেরিকার ২৬তম প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট বলেন, ‘সাফল্যের সূত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক উপাদান হলো মানুষের সাথে কীভাবে চলতে হয় তা জানা।’ সে ক্ষেত্রে বলা যায়, সফলতার অন্যতম সূত্র ভালো নেতৃত্ব। তাছাড়া ইতিবাচক সম্পর্ক সবক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে অহঙ্কার চলে আসা ভালো না। অনেক সফল ব্যক্তির মধ্যে অহঙ্কারের ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। তারা নিজের সীমাবদ্ধতা বোঝেন। বোঝেন অন্যেরটাও। ক্ষমা চাইতে জানেন। করতেও জানেন।

পড়াশোনা করেন এবং একটি রুটিন অনুসরণ করেন  : 

সফল ব্যক্তিরা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় নিয়ে পড়াশোনা করেন। যত কাজই থাকুক না কেন বইয়ের দুনিয়ায় তারা ডুব দেবেনই। কারণ এতে করে মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে পরিপূর্ণভাবে। প্রত্যেক সফল ব্যক্তির সকালের নিজস্ব একটা রুটিন থাকে। তারা ঘুম থেকে ওঠেন ভোরে যাতে করে দিনে কাজ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সময় পান। তারপর তারা ব্যায়াম করেন। সারা দিনে কী করবেন তার একটা রুটিন তৈরি করে ফেলেন। যাতে করে দিনের প্রতিটা মুহূর্তকে কাজে লাগানো যায়।

জেনে নিন কী কী ভুল এড়িয়ে চলেন সফল ব্যক্তিরা:

প্রথম ভুল :

চলতি ট্রেন্ডের পথে হাঁটা

আমেরিকান সাহিত্যিক ও কবি জ্যাক কেরুয়াক বলেছিলেন, ‘মহান কোনো কর্মসাধনা তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয় না যাঁরা চলতি কোনো ঝোঁক, খেয়াল এবং জনপ্রিয় গতানুগতিক পন্থাগুলো সঙ্গে নিয়ে চলেন। ‘ জ্যাকের উক্তির প্রসঙ্গ টেনে মার বলেন, ‘আমরা প্রায় সময়ই নতুন কিছু গড়ে তুলতে ঝাঁপ দিই, নতুন কোনো পথ সৃষ্টি করতে চাই। মাঝেমধ্যেই নতুন কিছু করার প্রবণতা কল্পনায় চকচকে বস্তুর ঝলকানির মতো উপসর্গ হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু প্রতিটি কাজে নতুন উপায় খুঁজতে গেলে তার ভালো দিকগুলো গভীরতার সঙ্গে উপলব্ধি করা যায় না। ফলে সেখান থেকে বাস্তবমুখী স্থায়ী কোনো শিক্ষাও অর্জিত হয় না। ‘ তাই চলতি ট্রেন্ডের (ঝোঁক) সঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে আপনি কোন ক্ষেত্রে সফলতা চান তার মূলটা টেনে বের করে আনার চেষ্টা করুন এবং বাকিটুকু ফেলে দিন। উদাহরণ হিসেবে বারনার্ড বলেন, ‘সেলস বা মার্কেটিংয়ে সফলতা পেতে চাইলে চলমান সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের পদ্ধতি অনুসরণ না করে আপনার আগে হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে গবেষণা করা উচিত। ‘

দ্বিতীয় ভুল : 

দায়িত্ব নিজের কাঁধে না চাপানো

মার বলেন, ‘সফল ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রথম যে জিনিসটি নজরে পড়ে তা হলো, ব্যর্থতার জন্য অন্য কাউকে দোষ দেওয়া বা নিজেকে ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নেই। যাঁরা সফল তাঁরা ব্যর্থ হলে কখনো বলেন না আমি ওই কারণে করতে পারিনি বা এটা আসলে তার দোষ। ‘ অর্থাৎ নিজের ভুলের দায় নিজের কাঁধেই নিয়ে নেন তাঁরা। মারের মতে, এই ব্যক্তিরা নিজের ভুল নিজে স্বীকার করে নেন ভুল থেকে শিক্ষা নিতে এবং ভবিষ্যতে তা এড়িয়ে চলার জন্য।

তৃতীয় ভুল : 

একাই সব করতে যাওয়া

জটিল যে কাজটি সফল ব্যক্তিরা করেন তা হলো, অন্য সফল ব্যক্তিদের মধ্যেও তার আনাগোনা থাকে। এর ব্যাখ্যায় বারনার্ড বলেন, ‘কোনো মানুষ একা গোটা একটি দ্বীপের মতো নয়। কোনো মানুষের একার কাছে যাবতীয় কাজের নেটওয়ার্ক নেই। তাই বুদ্ধিমান ও সফল ব্যক্তিদের কাছাকাছি থাকলে যে কেউ সাফল্য ও বিফলতার মধ্যে সহজেই পার্থক্য করতে পারেন। ‘

সব শেষে মারের উপদেশ হলো, এই তিনটি মৌলিক ভুল এড়িয়ে চললে যেকোনো কাজের সফলতা প্রায় হাতের মুঠোয় চলে আসবে। শুধু তাই নয়, একটি সাধারণ কাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করতেও এই তিনটি ভুল এড়িয়ে চলতে হবে। তবে সাফল্য যেমন দরকার, তেমনই প্রয়োজন সুখী হওয়া ও তৃপ্ত থাকা। কারণ মারের ভাষ্য, ‘একটি লক্ষ্য পূরণের পর যখন আপনি সুখী হবেন একমাত্র তখনই তা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সফলতা বয়ে আনবে। ‘

তথ্যসূত্রঃ মানবজমিন, দেশ রুপান্তর , জাগোনিউজ-২৪ ডটকম , কালেরকন্ঠ 

0 Shares:
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like
Read More

বাংলা ভাষা শেখার গুরুত্ব এবং লার্নটাইমের ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম 

মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। দূর বিদেশে অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন যাদের মাতৃভাষা বাংলা । বাংলাভাষী মানুষ…