পড়া মনে না থাকার কারণ 

সত্যিই কি আমাদের পড়া মনে থাকে না? নাকি আমরা ঠিক মত পড়ি না ?  কোনটা হতে পারে ? 

চলুন তাহলে এ বিষয়ে জেনে নেই 

আমাদের পড়া মনে না থাকার দুটো কারণ আছে 

১। মন দিয়ে না পড়া।

২। স্মৃতি শক্তি দুর্বল হলে।

স্মৃতি শক্তি দুর্বল বলতে, যারা পড়াশোনায় পিছিয়ে তাদের কথা বলা হচ্ছে না । এখানে স্পেশাল চাইল্ড দের কথা বলা হচ্ছে । তার বাইরে যে সমস্ত মানুষ মনে করে আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল আমি পড়া মনে রাখতে পারি না। তারা কেবলমাত্র পড়া বিষয় টা নিয়ে অজুহাত দাঁড় করে।তবে হ্যাঁ এটা হতে পারে, কেউ হয়ত  একবার পড়লেই সব পড়া মুখাস্থ করে ফেলে, আর কারও হয়ত একটু সময় লাগে।আর এই সময় বেশি লাগে বলেই তারা ধরে নেয়,আমি মনে হয় পড়া মনে রাখতে পারি না।

কিছু ছেলে মেয়েদের স্মৃতি শক্তি জন্ম থেকেই প্রখর হয়, কিন্তু কিছু ছেলে মেয়েকে একটু বেশি খাটতে হয়। পার্থক্য এই টুকু। তবে আপনি যদি মেনে নেন যে, আপনার স্মৃতি শক্তি ভালো না, তাহলে এটা জেনে রাখুন আপনি ঐ ভালো না দিকেই দিন দিন এগিয়ে যাবেন। কারণ আমরা আমাদের সচেতন মনে যেটা বলি, আমাদের অবচেতন মন সেটা কেই গ্রহণ করে। স্পেশাল চাইল্ড ছাড়া, বাকি সবার মধ্যেই ক্লাসের পড়া টুকু মনে রাখার মতো স্মৃতি  আছে। হ্যাঁ এর মধ্যে হয়ত কেউ প্রথম স্থান অধিকার করবে, কেউবা থাকবে সবার শেষে।

তবে যে শেষের স্থানে আছে, তার চিন্তার কোনো কারণ নেই, শেষ স্থান অধিকার করা বাচ্চা টির মধ্যেও কোনো না কো্নো স্পেশাল গুন আছে, যেই গুনটি  যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে তার মধ্যে নেই। কারণ প্রতিটি মানুষই কোন না কোন অনন্ত গুনের অধিকারী। প্রতিভা সবার মধ্যেই আছে, প্রয়োজন শুধু একটু ধৈর্য্য ধরার। এবং আমার কিসে আগ্রহ সেটা খুঁজে বের করা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বাবা, মায়ের ভূমিকা অপরিসীম।বাচ্চার থেকেও বাবা, মা কে বেশি ধৈর্য্য ধরতে হবে।

বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিশনের নাম সকলেই জানেন। তাঁর স্কুল জীবন ছিল তিক্ততায় ভরা।তিনি খুব বেশি দিন স্কুলে টিকতে পারেন নি।লেখা পড়ায় মনোযোগ না থাকায় তাঁর শিক্ষকরা তাঁর উপর খুবই বিরক্ত ছিলেন।

তিনি লেখা পড়ায় খুব একটা মন বসাতে পারতেন না।তিনি স্কুলে একটি পরীক্ষায় খুব খারাপ ফলাফল করেন।এই ঘটনার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে একটি চিঠি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। টমাস তখন বুঝতে পেরেছে যে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।

তিনি বাড়িতে গিয়ে সেই চিঠিটা মায়ের হাতে তুলে দিলেন। তাঁর মা চিঠিটি নিয়ে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তারপর এডিশনের দিকে তাকিয়ে চিঠিটি পড়তে লাগলেন।

তিনি চিঠি টি উচ্চস্বরে পড়তে আরম্ভ করলেন—

” আপনার পুত্র খুব মেধাবী।এই স্কুল টি তাঁর জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাঁকে পড়া দেখানোর মত যথেষ্ট প্রশিক্ষক নেই।দয়া করে আপনি নিজেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করুন”। চিঠিতে লেখা কথা গুলো শুনে এডিশনের চোখ জলে ভরে উঠলো অশ্রুতে।

তখন থেকেই তিনি মায়ের কাছেই শিক্ষা নেওয়া শুরু করেন। তিনি এগারো বছর বয়সে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর বই পড়ে ফেলেন। এক সময় তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নানা আবিষ্কার করেন। তিনি তাঁর মায়ের অনুপ্রেরণায় বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করে পৃথিবী কে আলোকিত করেছিলেন। এর জন্য তিনি কিন্তু হাজার ও বার ব্যর্থ হয়েছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েননি।

অনেক বছর পর তিনি একদিন পুরানো কাগজ পত্র ঘাটছিলেন। তখন একটা পুরনো কাগজের দিকে তাঁর নজর পড়ল। তিনি কাগজটি হাতে নিয়ে দেখেন, এটা স্কুলের পাঠানো সেই চিঠি।

সেদিন সেই চিঠি পড়ে তিনি ডুকরে ডুকরে কেঁদে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ছিলেন। সেই চিঠিতে লেখা ছিল—

” আপনার সন্তান স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন শিশু।সে এই স্কুলের উপযুক্ত নয়।আমরা কোনও ভাবেই তাঁকে আমাদের স্কুলে জায়গা দিতে পারি না”।

তাহলে একবার ভাবুন তো, টমাস আলভা এডিশনের মা যদি সেদিন ধরে নিতেন যে তাঁর সন্তান স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন, তাই তাঁর পিছনে সময় নষ্ট করে আর লাভ নেই। পড়া শোনা করানোর ও কোনও প্রয়োজন নেই। তাহলে আজ আমরা কি করে আলোর নীচেই বসে পড়তাম ! টমাস আলভা এডিশনের কিন্তু পড়াতে সমস্যা ছিল না, সমস্যা ছিল স্কুলের পড়ানোর পদ্ধতিতে।

আমাদের মস্তিষ্ক অনেকটা ব্যাংকের মত । প্রতিদিন মনের ব্যাংকে জমা হয় অজস্র চিন্তা ভাবনা। এই সব চিন্তা ভাবনা যদি ইতিবাচক হয়,তাহলে আপনি কোটি পতি। আর নেতিবাচক হলে ভিখারী।শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তব। তাই পড়ে মনে রাখার আগে পড়াটা যে পড়া প্রয়োজন সেটা মাথায় ঢুকিয়ে নিন। আমি পড়া মনে রাখতে সক্ষম এই কথা টা বার বার বলুন। আমি পড়া মনে রাখতে পারি না এটা বলা থেকে বিরত থাকুন। প্রচুর পড়াশোনা করুন, পড়া মনে না থেকে যাবে কোথায়।

এছাড়া—

১। পড়তে বসে হাজার ও চিন্তা মাথায় আনবেন না। কাল কোন বন্ধু কি বলেছিল, কে কি আপনার সম্পর্কে ভাবছে ইত্যাদি কথা ভাবা বন্ধ করুন।

২। প্রতিদিন কিভাবে পড়াটা আরো বাড়ানো যায, সেটা নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন।

৩। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখা অভ্যাস করুন এবং প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখুন।এতে পড়া মনে থাকে।

৪। এমন বন্ধু নির্বাচন করুন যে পড়াশোনা করে। যার কাছে আপনি অনুপ্রেরণা পাবেন।

৫। সব থেকে বেশি মনোযোগ দিতে হয় নিজের প্রতি, নিজের প্রতি ইনভেস্ট করুন, মানে নিজের বেসিক চাহিদা গুলো পূরণ করুন। যেমন অনুপ্রেরণা মূলক বই পড়ুন, নিজেকে মাঝে মাঝে একা রাখুন।মন কি চাই জিজ্ঞাসা করুন। 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো কিছু শেখার ঠিক চার ঘণ্টা পর যদি শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করা হয় তাহলে সেটা বেশ ভালোভাবে মনে রাখা যায়। কোনো কিছু মনে রাখার ব্যাপারে এই কৌশলের কথা বলছেন ডাচ বিজ্ঞানীরা। ৭২ জন মানুষের স্মৃতিশক্তির ওপর গবেষণা চালিয়ে তারা একথা বলছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করার সময় শরীর থেকে প্রোটিন নির্গত হয়।

মস্তিষ্কের যে অংশটি স্মৃতি রক্ষায় কাজ করে প্রোটিন সেই অংশটিকে আরো বেশি চাঙা করে তুলে। তবে এই গবেষণায় বলা হচ্ছে, কোনো কিছু মনে রাখার ক্ষেত্রে কতোক্ষণ পর এই শরীর থেকে প্রোটিন নির্গত হচ্ছে তার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করছে।

তারা বলছেন, লেখাপড়া করার সাথে সাথে বা পরে পরেই নয়, বরং যদি চার ঘণ্টা পরে ব্যায়াম করা হয় তাহলে সেটা ওই পড়া মনে রাখতে সবচে বেশি সাহায্য করে। প্রথমে এই গবেষণার জন্যে ৭২ জনকে সংগ্রহ করা হয়। তারা প্রথমে ৪০ মিনিট পড়াশোনা করেন।তারপর এদেরকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়।

একটি গ্রুপের সদস্যরা পড়ালেখার পরপরই ব্যায়াম করতে শুরু করেন। দ্বিতীয় গ্রুপটি শরীর চর্চা করেন পড়াশোনা করার চার ঘণ্টা পর। আর তৃতীয় গ্রুপটি কোনো ধরনের ব্যায়ামই করেনি। প্রথম দুটো গ্রুপের সদস্যরা সাইকেল চালিয়ে ৩৫ মিনিটের মতো ব্যায়াম করেন। এর দু’দিন পর এই তিনটি গ্রুপের সবাইকে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে তাদের কে কতোটুকু মনে রাখতে পেরেছে।

দেখা গেছে দ্বিতীয় গ্রুপটি, অর্থাৎ যারা পড়াশোনার চার ঘণ্টা পরে ব্যায়াম করেছিলো, তারাই সবচে ভালোভাবে পড়া মনে রাখতে পেরেছে। এম.আর.আই-এর সাহায্যে প্রত্যেকের মস্তিষ্কের ছবি তুলে দেখা গেছে মস্তিষ্কের যে অংশটি – হিপোক্যাম্পাস – যা কোনো কিছু মনে রাখার জন্যে কাজ করে, দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যদের মস্তিষ্কে সেটা সবচে বেশি তীক্ষ্ণ ও সতেজ।

ধারণা করা হচ্ছে, শরীর চর্চার ফলে শরীরে যেসব রাসায়নিক উৎপন্ন হয় – যেমন ডোপামিন, নোরেপাইনফ্রাইন, এসব স্মৃতিশক্তিকে জোরালো করতে সাহায্য করতে পারে। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের ডন্ডার্স ইন্সটিটিউট ফর ব্রেইন, কগনিশন এন্ড বিহেভিওরের বিজ্ঞানী গুইলেন ফার্নান্দেজ। তিনি বলেছেন, তাদের পরীক্ষার ফলাফল থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সময় মেপে শরীর চর্চা করলে দীর্ঘমেয়াদে স্মৃতিশক্তির উন্নতি হতে পারে। যেসব স্মৃতি দুর্বল হয়ে গেছে সেগুলোকেও সম্ভব জোরালো করা। তবে কয়েক ঘণ্টা পরে ব্যায়াম করলে সেটা কেনো স্মৃতিশক্তির জন্যে ভালো হয়, সেই রহস্যটা এখনও পরিষ্কার নয়।

পরিশেষে বলব, আপনি একটু মন দিয়ে, ধৈর্য্য ধরে পড়ুন।কেবল পড়ে যান।এই সময় টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।এই সময় ই পরবর্তী জীবনের দিশা ঠিক করে দেবে।আপনি এই সময় টা যেমন ভাবে কাটাবেন, তার উপরেই নির্ভর করবে আপনার ভবিষ্যত। তাই অনেক করে পড়ুন।

তথ্যসূত্রঃ Quora , বিবিসি নিউজ বাংলা 

0 Shares:
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like
Read More

ছাত্রজীবনে যা  অর্জন করা উচিৎ 

বৈচিত্র্যময় জীবনে ধাপে ধাপে বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার সঞ্চার ঘটে । ছাত্রজীবন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ছাত্রজীবন শেষে যখন পেশাজীবনে প্রবেশ…
Read More

তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন  

আধুনিক সভ্যতার এই বিশ্বায়নের যুগে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বত্র। শিল্প বিপ্লবের পর তথ্যপ্রযুক্তিতে দ্রুত  উন্নয়ন  লাভ পৃথিবীতে সবচেয়ে…
Read More

আপনি জানেন কি আপনার সন্তান পরীক্ষায় কেন ভালো করতে পারছেনা ?

আপনার সন্তান ভালো করতে পারেনা তার কারণ গ্রুপভিত্তিক ক্লাসে যখন দেখে তার সহপাঠিরা খুব ভালো করছে এবং তুলনামূলকভাবে…