বাংলা ভাষা শেখার গুরুত্ব এবং লার্নটাইমের ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম 

মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। দূর বিদেশে অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন যাদের মাতৃভাষা বাংলা । বাংলাভাষী মানুষ বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেছে, ভালোবাসে এবং ভালোবাসবে। তবে তাদের আগামী প্রজন্ম বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে শিখতে পারবে কিনা এই ভয়ে দিন কাটে তাদের। এই ভয়কে দূর করতে লার্নটাইমের ভাষা শিক্ষাকার্যক্রম চালু রয়েছে যেখানে শুদ্ধভাবে বাংলা শেখানো হয় । এই প্রসঙ্গে প্রবন্ধের শেষে বিস্তারিত আলোচনা করব ।

বলছিলাম বাংলা ভাষার প্রতি বাংলাভাষী মানুষের  সহজাত ভালোবাসার কথা এর বাইরেও বাংলা ভাষা নিয়ে বিশেষ গৌরব করার কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যার স্বাধীনতার সংগ্রাম বিকশিত হয়েছিল ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে ভারতবর্ষের মুসলমানরা স্বাধীন হবে_ এ স্বপ্নে সবচেয়ে বেশি বিভোর হয়েছিল বাঙালি মুসলমানরাই। পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠানরা সে দৌড়ে পেছনে ছিল। ভারত বিভাগ যে বাঙালির মুক্তি নিয়ে আসেনি, বাঙালি মুসলমানরা তা প্রথম বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে শুধু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণায়। তারই প্রতিবাদে ভাষার দাবি আদায়ে জীবন দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাস এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করল বাঙালি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় মূলত ভাষা আন্দোলনের ফসল। আর এ পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরেও পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। অবশ্য ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনীয়ও একাধিক দেশের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে। এর বাইরেও ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বৃহৎ নগরগুলোতে রয়েছে ‘লিটল বেঙ্গল’। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বাইরে সেসব জায়গায় চীনা, পাঞ্জাবি, গ্রিক বা ইতালীয়দের মতোই বাঙালি সংস্কৃতি সুপরিচিত। শান্তিরক্ষীদের কল্যাণে আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে- এও এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। গ্রেকো রোমান, হিব্রু-আরবি বা সংস্কৃত-প্রাকৃতের মতো ধ্রুপদী ভাষাগুলো ছাড়া এত দীর্ঘ ধারাবাহিক সাহিত্যসম্পদ পৃথিবীর কম ভাষারই আছে। বিষয়বৈচিত্র্যেও এই সাহিত্যকীর্তি অনন্যসাধারণ। বৌদ্ধ সনাতন, শাক্ত বৈষ্ণব, মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ লোকসাহিত্য মিলে বাংলা সাহিত্য তাই এত ঋদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের এই বিপুল ভাণ্ডারে মিশে আছে আরব, পারস্য, পর্তুগিজ, ইংরেজ থেকে প্রতিবেশী আরাকান পর্যন্ত; আসাম, উৎকল বা মিথিলার সঙ্গেও তার যোগ সামান্য নয়।

বাংলা ভাষায় একজন কবি আছেন, নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যে এশিয়ায় প্রথম নোবেল নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত তার রচিত_ বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা। এমন ঘটনা জাতীয় সঙ্গীতের ইতিবৃত্তে আর নেই।

বাংলা ভাষার অক্ষরের শক্তি অনেক। প্রায় সব উচ্চারণই বাংলা অক্ষর দিয়ে বর্ণিকর করা যায়। সব ভাষার এ শক্তি নেই। ইংরেজিতে ‘ট’ (T) আছে; ‘ত’ নেই। জাপানি সব ‘ল’কে ‘র’ বানিয়ে ফেলে। আরবিতে ‘প’ নেই; তাই পাকিস্তানকে ‘বাকিস্তান বানিয়েছিল। বানান ও উচ্চারণের সংঘাতও বাংলায় কম। ‘ক্ষ’ (ক+ষ)-র মতো দু’একটি অক্ষর ছাড়া উচ্চারণ আর বানান একই। ‘পঙ্ক্তি’র মতো মাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রম চোখে পড়ে।

বানান থেকে উচ্চারণে উহ্য শব্দের অত্যাচার নেই। ‘নাইফ’ (knife) লিখতে গিয়ে অযথা একটি k সংযোগের মতো ঘটনা বিরল।  Beauty লিখতে গিয়ে প্রায় সব স্বরবর্ণের সার বেঁধে দাঁড়ানোর মতো অবস্থাও নেই। Jose  লিখে ‘হোসে’ পড়তে হবে, দীর্ঘ renaissance লিখব, পড়ব রেনেসাঁ অথবা ভার্সাই শহরের নাম লিখতে অতিরিক্ত‘lles লেখার বিড়ম্বনা বাংলা ভাষায় নেই।

বাংলা ভাষা আবেগের ভাষা। সমগ্র মধ্য যুগজুড়ে কাব্য লেখা হয়েছে সে ভাষায়। চণ্ডীদাস, আলাওল, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র থেকে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ তৈরি করেছেন বাংলার কাব্যভাষা। বাংলা ভাষা যুক্তিরও ভাষা। তা দিয়েই ধর্মের তর্ক করেছেন রামমোহন রায়, বিজ্ঞানের কথা বলেছেন অক্ষয় কুমার দত্ত, জগদীশচন্দ্র বসুরা। আবার গল্প-উপন্যাস-নাটকেরও ভাষা হয়েছে বাংলা। বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়রা সে ভাষায় এনেছেন পরিপকক্কতা। নবরূপে তাকে উপস্থাপনা করেছেন প্রমথ চৌধুরী।

আমাদের দেশে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষায় দানের প্রয়াস ১৯৬০-এর দশক থেকেই। স্বাধীনতা লাভের পর তা বেগবান হয়েছিল; কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ থেকে উল্টো যাত্রায় তা ধীরে ধীরে থেমে গেছে। এমন ধারণা বদ্ধমূল করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে যে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, চিকিৎসা বা প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষা সম্ভব নয়। চীনা বা জাপানের কথা তখন আবার মনে পড়ে! আসলে বিশ্বজ্ঞানকে অনুবাদ ও রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আত্তীকরণ করার কাজটি আমরা ঠিকমতো করতে পারছি না। ইংরেজি শিখছি বলে যতই আনন্দিত হই না কেন, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় দক্ষ এমন জ্ঞানীর সংখ্যা হাতেগোনা।

এর সঙ্গে নতুন ঝামেলা বিকৃত বাংলা। বাংলা বাক্যের আদি-অন্ত-মধ্যে ইংরেজি শব্দ বসিয়ে একটা খিচুড়ি তৈরি হচ্ছে। সো, বাট প্রভৃতিকে যত্রতত্র সংযোজন, বাক্যের মধ্যে অকারণে ‘কিন্তু’ ব্যবহার, আঞ্চলিক ভাষার আবরণে অদ্ভুত শব্দ ও উচ্চারণ এবং প্রায় সমগ্র বাক্যে নাসিক্য উচ্চারণ যোগ_ সব মিলিয়ে মাতৃভাষা বাংলার এক বিপর্যস্ত অবস্থা!

তবু এত কিছুর পরও আমরা আশায় বুক বাঁধতে চাই। সংকট-উত্তরণের মতো ঐশ্বর্য মাতৃভাষা বাংলায় আছে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথা আমার ছেলেবেলার এক জায়গায় লিখেছেন, `তখন আমাদের ঐ সময়টা কাটত চাকরদের মহলে। তখনও ইংরেজি শব্দের বানান আর মানে-মুখস্থর বুক-ধড়াস সন্ধেবেলার ঘাড়ে চেপে বসে নি। সেজদাদা বলতেন, আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তার পরে ইংরেজি শেখার পত্তন। তাই যখন আমাদের বয়সী ইস্কুলের সব পোড়োরা গড়গড় করে আউড়ে চলেছে I am up আমি হই উপরে, He is down তিনি হন নীচে, তখনও বি-এ-ডি ব্যাড, এম-এ-ডি ম্যাড পর্যন্ত আমার বিদ্যে পৌঁছয় নি।’

রবীন্দ্রনাথের শৈশবে তাঁর সমবয়সী ছেলেরা যখন ভিনদেশি ভাষা ইংরেজি শেখার অমন কসরত করছিল, তিনি তখন মন দিয়ে শিখছিলেন মাতৃভাষা বাংলা। ইংরেজি তিনি শিখেছিলেন আরও পরে, বাংলা ভাষার গাঁথুনি বা ভিত শক্ত হওয়ার পর। ওই বিদেশি ভাষা তিনি বেশ ভালোভাবেই শিখতে পেরেছিলেন; নিজের লেখা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন নিজেই। সেই সব লেখা পড়েই সুইডিশ নোবেল কমিটি তাঁকে সাহিত্যে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়েছিল।

এখন, এতকাল পর ভাষাবিজ্ঞানী, মস্তিষ্কবিজ্ঞানী ও শিক্ষা গবেষকেরা গবেষণা করে বলছেন, রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাতলানো পদ্ধতিটাই বিদেশি ভাষা শেখার সবচেয়ে কার্যকর ও ফলপ্রসূ পদ্ধতি। প্রথমে মাতৃভাষার ভিতটা মজবুত করতে হবে, তাহলে বিদেশি ভাষা শেখার কাজটা সহজ হয়ে আসবে।

কারণ, শিশু যখন মাতৃভাষায় পড়া ও লেখা শিখতে শুরু করে, তখন থেকে ভাষার মাধ্যমে চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জানা ও বোঝার ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি আরও অনেকগুলো সক্ষমতা বা দক্ষতা তৈরি হতে থাকে; বিশেষ করে, যুক্তি–বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল থিংকিং। এই সমস্ত ক্ষমতা নিয়েই সে পড়াশোনার পরবর্তী ধাপে যায়। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলছেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে অর্জিত কোনো সক্ষমতাই হারিয়ে যায় না; বড় হয়ে দ্বিতীয় কোনো ভাষায় পড়াশোনা করতে গেলে মাতৃভাষায় রপ্ত করা বিষয়গুলো আর নতুন করে শিখতে হয় না।

যেমন, যদি কোনো শিশু তার মাতৃভাষার কোনো অজানা শব্দের মানে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা কনটেক্সট থেকে অনুমান করার সক্ষমতা অর্জন করে, কিংবা মাতৃভাষায় কোনো কিছু পড়ে তার আক্ষরিক অর্থ ছাড়িয়ে নিহিতার্থটা বুঝে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে যখন সে বিদেশি কোনো ভাষায় পড়াশোনা শুরু করে, তখন তার এই দুই সক্ষমতা সহজেই স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ মাতৃভাষায় সে যা পারে, বিদেশি ভাষায়ও তা পারে। কিন্তু এ ধরনের বিমূর্ত সক্ষমতাগুলো সরাসরি বিদেশি ভাষায় গড়ে তোলা অনেক কঠিন।

গবেষকেরা আরও বলছেন, শিশুর ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়বোধ গঠনে মাতৃভাষার ভূমিকা ব্যাপক। যে শিশুর মাতৃভাষার ভিত মজবুত, সে নিজেকে গভীরভাবে বুঝতে পারে, তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়, সে সমাজে নিজের অবস্থান সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে। এই সক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই তার শিক্ষাগত অর্জনসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজে লাগে। এই কারণে পৃথিবীজুড়ে দ্বিভাষিক শিক্ষাপদ্ধতির জনপ্রিয়তা বাড়ছে  । 

এই প্রবন্ধ থেকে বুঝতেই পারছেন বাংলা ভাষার  গুরুত্ব কতটুকু । এছাড়া গবেষণায় উঠে এসেছে শিশুরা যত বেশি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে তাদের আইকিউ লেভেল তত বেশি শক্তিশালী হবে । যেহেতু প্রবাসে আছেন আপনার সন্তান হয়ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্য কোন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করবে কিন্তু আপনার প্রিয় ভাষা বাংলাটা তার শেখা হবেনা যা আপনাকে পীড়া দিবে । আপনার সন্তানকে বহুভাষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিশেষ করে বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে শেখাতে লার্নটাইমের ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন ।  

লার্নটাইম আপনার সন্তান যে দেশে বড় হচ্ছে সেই দেশের কনটেক্স ব্যবহার করে ওয়ান টু ওয়ান পদ্ধতিতে শুদ্ধভাবে বাংলা শেখাবে । লার্নটাইম সহজ পদ্ধতিতে কনভার্সেশনের মাধ্যমে বাংলা শিখিয়ে থাকে ।  লার্নটাইম বিশ্বাস করে আনন্দের সহিত পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করা বহুগুণে শেখার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় । লার্নটাইমের ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে ,

১। বাংলা ভাষা 

২। ইংরেজি ভাষা

৩। জাপানী ভাষা

৪। চিনা ভাষা

৫। কোরিয়ান ভাষা 

রেফারেন্সঃ 

১। বাংলা ভাষার ঐশ্বর্য ও সংকট; সমকাল 

২।মাতৃভাষার গুরুত্ব কি শুধু দেশপ্রেমের বিষয়?প্রথম আলো 

0 Shares:
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like
Read More

বাচ্চাকে জিনিয়াস হিসাবে গড়ে তোলার কৌশল 

‘প্র্যাকটিস মেকস এ ম্যান পারফেক্ট’ অর্থাৎ চর্চার মাধ্যমে, পরিশ্রমের মাধ্যমেই শুধু চূড়ান্ত সাফল্য বা দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব…