সুন্দর করে কথা বলার কৌশল 

আপনারা অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন, ‘ কথা বলা’ এ আর এমন কী? কিন্তু জেনে রাখুন, শুধু সুন্দর করে কথা বলার গুণ আপনার ক্যারিয়ারকে নিয়ে যেতে পারে অনন্য উচ্চতায়। শিক্ষকের সঙ্গে, ব্যবসায়িক বা কোনো উদ্ভাবনী ভাবনা উপস্থাপনের সময়, এমনকি করপোরেট দুনিয়ায় বুদ্ধিদীপ্ত কথা আপনার লক্ষ্য অর্জন অনেক সহজ করে দিতে পারে। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের তথ্যমতে, যাঁরা পেশাজীবনে প্রাঞ্জলভাবে কথা বলেন, তাঁদের সাফল্য আসে দ্রুত। আবার কথা বলা কিন্তু একটি শিল্পও বটে। সাবলীল কথা বলার গুণ চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করা যায়। 

প্রথম আলোর প্রকাশিত এক প্রবন্ধে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহকারী অধ্যাপক ও বিজনেস কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ সাইফ নোমান খান জানালেন কীভাবে সাবলীলভাবে কথা বলার চর্চা করা যায়। তিনি ১০ টি কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন, 

১. শরীর ও মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশ করা শিখুন

হাসিমুখে কথা বলা শিখুন আর শরীরী ভাষার দিকে নজর দিন। কথা বলার সময় হাত কোথায় রাখছেন, ঘাড় কতটুকু বাঁকাচ্ছেন কিংবা ভ্রু কতটুকু ব্যবহার করছেন—সবটাই খেয়াল রাখুন। চোখে চোখ রেখে কথা বলা শিখুন। যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁর দিকে না তাকিয়ে কথা বলা অসম্মান ও অভদ্রতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরী ভাষা সংশোধনে সময় নিন। টানা পাঁচ সপ্তাহ এমন চেষ্টা করুন, নিজের মধ্যে পরিবর্তন দেখবেন।

২. আঞ্চলিকতার টান পরিহার করা শিখুন

বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পেশাদারি যেকোনো কাজে বাংলা ভাষায় সুন্দর করে কথা বলতে নিজের আঞ্চলিকতা পরিহারের চেষ্টা করুন। শুরুতে হয়তো সমস্যা হবে, কিন্তু আঞ্চলিকতা অবশ্যই পরিহার করা যায়। টানা ছয়-সাত সপ্তাহ সময় দিলে আঞ্চলিক টান কথায় কমিয়ে আনতে পারবেন। ইংরেজিতে কথা বলার সময় পরিষ্কারভাবে ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান উচ্চারণ অনুসরণ করুন। কথার মধ্যে কখন, কীভাবে, কতটুকু বিরতি নিতে হয়, তা নিজেই উপলব্ধি করুন।

৩. বুঝে কথা বলুন, শ্রোতাকেও বুঝুন

কথা বলার সময় মুখ আর মস্তিষ্কের মধ্যে সমন্বয় আনার চেষ্টা করুন। কথা শুরুর আগে কী বলবেন, তা গুছিয়ে নিন, প্রয়োজনে টুকরো কাগজে লিখে নিন। আপনি যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি কথা বুঝতে পারছেন কি না, সেদিকে মনোযোগ দিন। আপনি কী বলছেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার শ্রোতা কী শুনছেন বা কী বুঝছেন। আপনার কথায় আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। শ্রোতার মুখ ও শরীরের অভিব্যক্তি দেখে শ্রোতাকে বুঝতে চেষ্টা করুন।

৪. বক্তৃতার ক্ষেত্রে কৌশলী হোন

অনেক মানুষের সামনে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় আপনাকে খুবই কৌশলী হতে হবে। শ্রোতাদের চোখে তাকান। তাঁদের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে আপনার স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন করতে হতে পারে, সে জন্য তৈরি থাকুন। খুব দ্রুত কথা বলছেন কি না, সেটা বুঝতে হলে আগে নিজেই নিজের কথা মুঠোফোনে রেকর্ড করুন। বারবার অনুশীলন করুন।

কথা বলার সময় অবশ্যই বক্তব্য গুছিয়ে নেবেন। অন্তত একটা ছক তৈরি করে নিন। প্রথম মিনিটে কী বলবেন, দ্বিতীয় মিনিটে কী আলোচনা করবেন আর বক্তব্য শেষ করবেন কীভাবে—সাজিয়ে নিন।

৫. থিসিস বা গবেষণা উপস্থাপন: জটিল বাক্য ও নেতিবাচক কথা পরিহার করুন

যাঁরা গুছিয়ে কথা বলেন, তাঁরা আসলে কম শব্দে খুব বেশি কাজের কথা বলেন। কথা বলার সময় জটিল বাক্য ব্যবহার করবেন না। শব্দভান্ডার কিংবা বিদ্যার দৌড় কখনোই কথার মধ্যে প্রকাশের চেষ্টা করবেন না। সরল ও সাধারণ শব্দ ও বাক্যে কথা বলার চেষ্টা করুন। খেয়াল রাখবেন, কথা বলার সময় অন্য কারও নামে নেতিবাচক বাক্য কিংবা শব্দ কোনোভাবেই বলবেন না। নেতিবাচক বাক্য ব্যবহারে আসলে নিজের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। সমালোচনা করতে হলে যৌক্তিকভাবে করুন। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিন।

৬. সমস্যা নয়, সমাধান বলুন

ধরুন, আপনি একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে লিফটে উঠেছেন। ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য তাঁর সঙ্গে নিরিবিলিতে কথা বলার সুযোগ আপনি পাচ্ছেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে তাঁর সামনে কোনো ‘আইডিয়া’ উপস্থাপন করবেন? ২০-৩০ সেকেন্ডের মধ্যে কার্যকরভাবে একটা ভাবনা উপস্থাপন করাকে বলা হয় ‘এলিভেটর পিচ’। এসব ক্ষেত্রে সমস্যা নয়, সমাধান বলুন। শ্রোতার আগ্রহের জায়গা সম্পর্কে আগে জেনে নিন, সেভাবেই আপনার বক্তব্য তৈরি করুন। ‘আরেকটু সময় পেলে বোঝাতে পারতাম,’ এই মনোভাব রাখবেন না।

৭. অন্যকে অনুসরণ করুন, শিখুন

সুন্দর করে কথা বলার শিল্প রপ্ত করতে টেড–এর বিভিন্ন ভিডিওসহ হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ কিংবা ব্লুমবার্গ বিজনেস ম্যাগাজিনের বিভিন্ন ভিডিও দেখুন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লাইভ ভিডিও লেকচার দিয়ে থাকেন, সেগুলো দেখুন। ভিডিও থেকে তাঁদের মতো করে কথা বলা, বাক্য ব্যবহার আর শব্দ প্রয়োগ আয়ত্ত করুন। আপনি পেশাজীবনে যাঁর মতো হতে চান, তাঁকে অনুসরণ করতে পারেন।

৮. বলতে হলে পড়তে হবে

যাঁরা সুন্দর করে কথা বলেন, তাঁরা কিন্তু ব্যক্তিজীবনে অনেক পড়াশোনা করেন। পড়ার বিকল্প নেই। ফিকশন, নন-ফিকশন—সব ধরনের বই পড়ুন। নানা ধরনের বই পড়লে নিজের মধ্যে নানা বিষয়ে জ্ঞান ও তথ্য জমা হয়, তাই কথা বলার সময় গুছিয়ে বলে ফেলার শিল্প রপ্ত করা সহজ হয়। যেকোনো মিটিং কিংবা পাবলিক স্পিকিংয়ের ক্ষেত্রে কথা শুরুর আগে শ্রোতা কিংবা যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁর বা তাঁদের অনুমতি নিয়ে শুরু করুন। শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখার জন্য সঠিক তথ্য ব্যবহার করে কথা বলুন। খেয়াল রাখবেন, শ্রোতা যা জানেন, তার পুনরাবৃত্তি করা ঠিক নয়।

৯. চর্চাই সব

হুট করে সুন্দর কথা বলার শিল্প আয়ত্তে আসে না। নিজেকে বদলাতে চার থেকে পাঁচ মাস সময় দিন। এই বিনিয়োগ কিন্তু আজীবন কাজে আসবে। শেখার সময় ভুল হবেই, তা-ও শিখতে থাকুন। বাড়ির বড়দের কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে আপনার যত ভুল, তা জেনে নিন। মানুষের কটাক্ষে মন খারাপ না করে ভুল সংশোধনে মনোযোগ দিন। স্পষ্ট করে কথা বলুন।

১০. অনলাইনে কোর্স করুন

কোর্সেরা, ইউডেমি, ফিউচার লার্নসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কথা বলাসংক্রান্ত কোর্স করার সুযোগ আছে। তিন থেকে সাত সপ্তাহের একেকটি কোর্স থেকে কীভাবে সুন্দর করে কথা বলা যায়, তা শিখে নিতে পারেন।

0 Shares:
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like
Read More

তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন  

আধুনিক সভ্যতার এই বিশ্বায়নের যুগে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বত্র। শিল্প বিপ্লবের পর তথ্যপ্রযুক্তিতে দ্রুত  উন্নয়ন  লাভ পৃথিবীতে সবচেয়ে…
Read More

আপনি জানেন কি আপনার সন্তান পরীক্ষায় কেন ভালো করতে পারছেনা ?

আপনার সন্তান ভালো করতে পারেনা তার কারণ গ্রুপভিত্তিক ক্লাসে যখন দেখে তার সহপাঠিরা খুব ভালো করছে এবং তুলনামূলকভাবে…
Read More

পাইথন কেন শিখবেন?

পাইথন ডেভেলপারদের চাহিদাঃ টেকনোলজি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাইথন ডেভেলপারদের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজগুলোর প্রতিটি…