‘প্র্যাকটিস মেকস এ ম্যান পারফেক্ট’ অর্থাৎ চর্চার মাধ্যমে, পরিশ্রমের মাধ্যমেই শুধু চূড়ান্ত সাফল্য বা দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব বলে প্রচলিত যে বিশ্বাস রয়েছে, গবেষণায় দেখা যায় তা সর্বাংশে সত্য নয়।
প্রফেসর স্টেনলির গবেষণা বলছে, অল্প বয়সে কোনো বিষয় পরিষ্কার করে বোঝার, আত্মস্থ করার এবং সমাধান দেওয়ার ক্ষমতা যে শিশুর যত বেশি থাকে, পরবর্তী জীবনে তার সাফল্যের সম্ভাবনাও তত বেশি থাকে। প্র্যাকটিস অর্থাৎ নিয়মিত চর্চা বা কঠোর পরিশ্রম একমাত্র চাবিকাঠি নয়। এমনকি শিশুর আর্থ-সামাজিক অবস্থার গুরুত্বও ততটা নয়।
শিশুর জন্মের পর প্রথম আট বছর তার বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। এটি সময়টি পরিবর্তনের এবং সে পরিবর্তন শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের। তবে শিশুর প্রথম তিন বছর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং অল্প বয়সে আপনার শিশুর বুদ্ধিমত্তা শাণিত করার দিকে নজর দিতে হবে।
অন্য দিকে শিক্ষাবিদরা বহুবার সাবধান করেছেন, “শিশুদের জবরদস্তি করে প্রতিভাবান করে গড়ে তোলার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হয়। তাদের নানারকম সামাজিক এবং মানসিক সমস্যা তৈরি হয়।”
কিন্তু আপনি যদি আপনার বুদ্ধিমান বাচ্চাকে কোনো চাপের ভেতর না ফেলে তার বুদ্ধি বিকাশে সহায়তা করতে চান, নীচে বর্ণিত কিছু পন্থা চেষ্টা করতে পারেন:
১। শিশুকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করুন
বুদ্ধিমান শিশুদের উদ্বুদ্ধ রাখতে, আগ্রহী রাখতে তাদেরকে অভিনব সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে হয়। জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, সাহস বাড়ায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, দিনের পর দিন একইরকম গতানুগতিক জীবন আলস্য, স্থবিরতা ডেকে আনে।
২।প্রতিভা এবং আগ্রহকে উৎসাহিত করা
খেলাধুলো হোক বা সঙ্গীত হোক বা নাটকের ক্লাস, এসব নিয়ে আপনার শিশুর আগ্রহ থাকলে অল্প বয়স থেকে সুযোগ দিতে হবে। তাহলেই প্রতিভা বিকাশের সম্ভাবনা বাড়বে।
তবে ‘কিছু হওয়ার জন্য’ তাদের ওপর চাপ তৈরি করা হিতে বিপরীত হবে। সে যা নয়, তা বানানোর চেষ্টা করলে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবেনা।
৩। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আবেগের চাহিদাকে গুরুত্ব দিন
সমস্ত শিক্ষার মূলে রয়েছে জানার আগ্রহ, জিজ্ঞাসা। স্কুল শুরুর আগেই শিশুরা অনেক প্রশ্ন করে। ধৈর্য না হারিয়ে সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরী। তাদের বুদ্ধি বিকাশের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু যত “কেন” এবং “কীভাবে” প্রশ্ন তুলবে, স্কুলে তার সাফল্যের সম্ভাবনা ততই বাড়বে।
৪। জানা বা শেখার চেষ্টার প্রশংসা করুন, তার ক্ষমতাকে নয়
শিশুর শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে বেশি প্রশংসা করুন, ফলাফলকে ততটা করবেন । নতুন কোনো ভাষা শেখার জন্য তার চেষ্টা, এমনকি সাইকেল চালানোর জন্য তার চেষ্টা – এসবকে উৎসাহিত করুন । জানার চেষ্টা, শেখার চেষ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখার উৎসাহই পরবর্তী জীবনে তাকে সাফল্যের দরজায় নিয়ে যাবে।
৫। ব্যর্থতা ভীতিকর কিছু নয়
শিশুর ভুলগুলোকে তার শিক্ষার অংশ হিসাবে দেখতে হবে। ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণকে একটি সুযোগ হিসাবে দেখতে হবে। ভুল করলে বাচ্চাদের ভবিষ্যতে সঙ্কট মোকাবেলার ক্ষমতা বাড়ে।
৬। কোনো লেবেল বা তকমা নয়
কোনো লেবেল বা তকমা সেটে দিলে আপনার বাচ্চা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। ভবিষ্যতে কোনো ব্যর্থতার ভয়ে সারাজীবন সে কুঁকড়ে থাততে পারে।
৭। শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ
প্রতিভাবান শিশুরা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ চায়।তাদের নিজের গতিতে শিখতে চায়। চলতি শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে তাদের সেই বিশেষ চাহিদা পূরণে বাবা-মাকে শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত পরামর্শ করতে হবে।
৮। শিশুর সক্ষমতা যাচাই
বাড়তি চাপ দেওয়ার জন্য স্কুলের সাথে দেন-দরবার করার আগে আপনার শিশুর শারীরিক-মানসিক সক্ষমতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা নিতে হবে। আপনার শিশুর অনেক অজানা সমস্যা থাকতে পারে। যেমন ডিজলেক্সিয়া, তার মনোযোগের ঘাটতি থাকতে পারে, তার হাইপার-অ্যাকটিভিটি বা অতিমাত্রায় চঞ্চলতার সমস্যা থাকতে পারে।
৯। সুস্থ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিশ্চিত করা
একটি শিশু যখন বড় হয়, তখন চারদিকের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তিত্বে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত। আজকের শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক। তাই তার সুন্দর ও নির্ভয় শৈশব নিশ্চিত করার দায়িত্ব মা–বাবাসহ পরিবারের সব সদস্যের।
১০। সৃজনশীল খেলনার ব্যবস্তা করা
শিশুর খেলনা হতে হবে আবিষ্কারধর্মী, নাটকীয় ও সৃজনশীল। বয়সভেদে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ উপযোগী খেলনা নির্বাচন করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। ঘরে ও বাইরে দুই জায়গায়ই খেলা যায়—এমন খেলনা শিশুর মানসিক বিকাশে বেশি সহায়ক। শিশুকে এমন ধরনের খেলনা দিতে হবে, যা তার বুদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে।
১১। ছবি আঁকার সুযোগ করে দেওয়া
দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে শিশুরা যদি ছবি আঁকার সুযোগ পায়, তাহলে তারা মেধাবী ও বুদ্ধিমান হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, শিল্পচর্চার মাধ্যমে শিশুদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অভিনব চিন্তার মাধ্যমে শিশু যখন বিভিন্নভাবে শিল্পচর্চার সুযোগ পায়, তখন তার সৃজনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। সে অসাধারণভাবে ভাবতে ও চিন্তা করতে শেখে, যা তাকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে শেখায় এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে সে তখন সহজেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
১২। সংগীতচর্চা সুযোগ করে দেওয়া
সুখে-দুঃখে সংগীত যেমন আমাদের মনোরঞ্জন করে, তেমনি শৈশব থেকেই শারীরিক ও মানসিক অনেক কাজের ওপরেও রয়েছে সংগীতের নিবিড় প্রভাব। তাই শিশুকে একেবারে ছোটবেলা থেকেই সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করানো জরুরি। সংগীত মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে। ভালো সংগীত শুনলে মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নামের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়, যা কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে শিশুকে আগ্রহী করে তোলে।
১৩। বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলা
বই শিশু মনের সুপ্ত ভাবনার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। একসময় মা-খালা-দাদির মুখ থেকে ঠাকুমার ঝুলির গল্প শুনে সময় কাটত শিশুদের। এখন এর ব্যতিক্রম ঘটছে। আগেকার সেসব গল্প এখন শিশুরা শুনতে পারে না। শিশু বয়স থেকেই তাই শিক্ষামূলক বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। গল্পের বই পড়ার মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ প্রসারিত হয় এবং মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ে। এর ফলে শিশুরা জটিল শব্দ ও বাক্য সহজে বুঝতে পারে। এতে তার পড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় শিশুর বুদ্ধিমত্তা।
শিশুর সামগ্রিক বিকাশে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখার পাশাপাশি শিশুর মানসিক বিকাশের দিকেও নজর রাখুন। অভিভাবক হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে আপনাকেই।
প্রতিভাবান বাচ্চাদের চেনার উপায়
১। মনে রাখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা
২।খুব অল্প বয়সে পড়তে শেখা
৩। অস্বাভাবিক কিছু আগ্রহ, শখ অথবা বিশেষ কিছু বিষয়ে গভীর জ্ঞান
৪।বিশ্বের চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে ধারণা
৫।সবসময় প্রশ্ন করা
৬। উচ্চমানের রসিকতা বোধ
৭। সঙ্গীত নিয়ে আগ্রহ
৮। নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগ্রহ
৯। খেলার সময় নতুন এবং অতিরিক্ত নিয়মকানুন তৈরির ক্ষমতা
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি , ইউনিসেফ বাংলাদেশ ,প্রথম আলো .